আসিয়ানে এসআরএইচআর এবং মানবাধিকারের সন্ধান

নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, “স্বাধীন হওয়া মানে কেবল নিজের শিকল ফেলে দেওয়া নয়, এমনভাবে জীবনযাপন করা যা অন্যের স্বাধীনতাকে সম্মান করে এবং বাড়ায়।” যে অঞ্চলে সংস্কৃতির বৈচিত্রের আলোকে বোনা হয়, সেখানে ইন্দোনেশিয়ায় সাম্প্রতিক আসিয়ান কুইয়ার অ্যাডভোকেসি সপ্তাহের বাতিল এবং স্থানান্তর এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় যে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে সেটাই প্রমান করে। ইন্দোনেশিয়ার বেশিরভাগ অংশে সমকামীতা বৈধ হয়েছে, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং রক্ষণশীল আচরন এলজিবিটিকিউ ব্যক্তিদের সমান অধিকার এবং গ্রহণযোগ্যতার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।

বিভিন্ন গ্রুপের হুমকির মুখে নিরাপত্তার স্বার্থে আয়োজকদের ইভেন্টটি ইন্দোনেশিয়ার বাইরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এই হতাশাজনক পদক্ষেপ, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে ক্রমাগত বৈষম্য এবং কুসংস্কারের মুখোমুখি হয় তা তুলে ধরে। এটা স্পষ্ট যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (এসআরএইচআর) এবং মানবাধিকারের জন্য সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি।

সামাজিক গণমাধ্যমে ‘এলজিবিটিকিউ-বিরোধী’ মানসিকতা গড়ে উঠেছে যা আসিয়ান কুইর অ্যাডভোকেসি সপ্তাহের সময় কর্মী এবং আইনজীবীদের মধ্যে ধারণা বিনিময় করা কঠিন করে তুলেছে। একটি সর্বজনীন সমাজের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়ার যে সুযোগ থাকা উচিত ছিল ক্রমাগত সহিংসতা এবং আতঙ্ক তা বিঘ্নিত করেছে।

ইন্দোনেশিয়ান ওলামা কাউন্সিল, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে, ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে এরুপ কারন দেখিয়ে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানটির বিরোধিতা করেছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এবং মানবাধিকারের সার্বজনীন নীতির মধ্যে যে ব্যবধান তা দূর করার প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করা হয়। বিভিন্ন পরিচয় এবং মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাকে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে বেমানান হিসাবে না দেখে বরং সহানুভূতি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে নীতিগুলি সমুন্নত রাখতে হবে যা নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গা আরো জোরালো করবে।

এই প্রতিকুলতা সত্ত্বেও, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় ধৈর্য ধরে সমাজে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন চাইছে এবং অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে। এটা স্বীকার করতে হবে যে এলজিবিটিকিউ অধিকারের জন্য সংগ্রাম শুধুমাত্র যৌন দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় নয় বরং মানবাধিকারের জন্য একটি মৌলিক লড়াই, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সম্মান, মর্যাদা এবং সমতার দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয় তা নিশ্চিত করে।

এই অঞ্চলের প্রতিবেশী দেশগুলোও এলজিবিটিকিউ ব্যক্তিদের প্রতি বিভিন্ন স্তরের আইনি বিধিনিষেধ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে লড়াই করে আসছে। সিঙ্গাপুরে, সমকামী পুরুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক এখনও বেআইনি, অন্যদিকে মালয়েশিয়া যৌনতা সংক্রান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। এই ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয় যে এসব বৈষম্যমূলক আইন প্রতিহত করে বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়া একটি সমাজ গড়ে তোলা কতটা জরুরী হয়ে পড়েছে।

যেহেতু আসিয়ান কুইর অ্যাডভোকেসি সপ্তাহ ইন্দোনেশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে একটি নতুন স্থান পেয়েছে, অবশ্যই আমাদের সম্মিলিতভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হবে। এটি সরকার, ধর্মীয় নেতা এবং সুশীল সমাজের জন্য উন্মুক্ত আলোচনা এবং সহানুভূতি বাড়ানোর একটি ক্ষেত্র। এর মাধ্যমে, আমরা এমন একটি পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করতে পারি যেখানে সমস্ত ব্যক্তি বৈষম্য এবং সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকে এবং যেখানে যৌন অভিমুখিতা বা লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে মানুষের অধিকার সমুন্নত থাকে।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকারের জন্য এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের আহ্বানকে একাত্ম করা কোন ব্যক্তিগত লক্ষ্য নয় বরং সবার সমান মর্যাদা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। আসুন আমরা সহানুভূতি এবং বোঝাপড়া করে এগিয়ে যাই, প্রত্যেকের স্বাধীনতা এবং প্রাপ্য সম্মানের জীবন নিশ্চিত করি। তবেই আমরা আমাদের অঞ্চলে এবং এর বাইরে বৈচিত্র্যের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবো।

সূত্র: প্রথম আলো

 

Leave a Reply